ইখতিলাফ এড়িয়ে দুআ ও মেহনতে লিপ্ত হওয়া
মাওলানা খলীলুর রহমান সাজ্জাদ নোমানী দামাত বারাকাতুহুম
***********************
[মাওলানা খলীলুর রহমান সাজ্জাদ নোমানী দামাত বারাকাতুহুম উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম এবং মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহির ঘনিষ্ঠ সহচর এবং তাঁর জীবনীকার ও মালফুজাতের সংকলক হযরত মাওলানা মনজুর নোমানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির পুত্র। দারুল উলূম দেওবন্দের পাশাপাশি তিনি মদীনা শরীফেও আরবের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম থেকে ইলম হাসিল করেছেন। বর্তমানে দারুল উলূম (ওয়াকফ) দেওবন্দে মুহাদ্দিস হিসাবে খিদমতে নিয়োজিত আছেন। এছাড়া তিনি তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত ভারতের অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা আল ফুরক্বানের সম্পাদক। পীর যুলফিকার নকশাবন্দী থেকে তিনি খেলাফত লাভ করেছেন।
তাবলীগের মজুদা হালতের ব্যাপারে বেশ কয়েকবার রাহবারী দিয়েছেন। ২০১৮ সালের আওরঙ্গবাদ আলমী ইজতেমাতে তিনি মাওলানা সা’দ সাহেবের সহিত ওয়াকফ দেওবন্দের এক উলামায়ে কেরামের জামাত সহ শরীক ছিলেন।]
———————————————————–
কিছু প্রশ্ন এসেছে, কিন্তু এখন সেসবের উত্তর দেয়ার সময় নেই। এক প্রশ্ন এসেছে দাওয়াত ও তাবলীগের চলমান হালতের বিষয়ে। আমি নিজেকে এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার যোগ্য মনে করি না। [সুবহানআল্লাহ! উম্মত দরদী উলামায়ে কেরাম এমনই হয়ে থাকেন।] কয়েক বছর হয় আমি আমার মুখে কুলুপ এঁটে আছি। এগুলো মাথায় আসতেই আমার মনে হয় আমি কিছুই বলতে পারব না। বংশগত ভাবেই আমরা তাবলীগের গোলাম। আমার এবং আমার খান্দানের রন্দ্রে রন্দ্রে দাওয়াত ও তাবলীগের এহসানাত।
আপনি আপনাদের এতোটুকুই বলব, আপনারা হযরতগণ এর হেফাজত এবং দীর্ঘায়ুর জন্য দুআর এহতেমাম করুন। আল্লাহর ওয়াস্তে ফরীক (দলাদলি করে আলাদা হওয়া) হবেন না।
দারুল উলূম দেওবন্দে যখন আমাদের আকাবিরদের মধ্যে ইখতিলাফ হয়েছিল, আমি তখন মদীনা মুনাওয়ারাতে পড়াশুনা করছিলাম। যখন ছুটিতে বাড়ি ফিরলাম, বয়সের নাদানীর কারণে আমার থেকে কোন একটা শব্দ বের হয়ে গিয়েছিল। আমার পিতা (মাওলানা মনজুর নোমানী) রহমাতুল্লাহি আলাইহি বেশ শক্ত ভাবে তাম্বিহ (সংশোধন মূলক ধমকী) করে বললেন, “বড়দের ইখতিলাফে ছোটদের কথা বলা উচিত নয়।”
এটা বড়দের ইখতিলাফ। তাঁরা নিজেরাই সমাধান করে নিবেন। ছোটদের কোন ভাবেই দলাদলি করে পরস্পর বিরোধী হওয়া উচিত নয়। আমি এটাই শিখেছি। এখানে (তাবলীগের ইখতিলাফে) যারা আছেন তাঁরা সকলেই আমাদের বড়। আমাদের মাথার তাজ। আর এই কাজ হল মায়ের মত, যে সাথীদের ঈমান ও ইয়াকীনের দুধ পান করান। এই মাকে বেআবরু হতে দেখা আমাদের বদ কিসমত। তাই আমাকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে মজবুর (বাধ্য) করবেন না।
একটা কথা আমার খুব মনে হয়, আল্লাহ করুন, আমার ধারণা যেন ভুল হয়, নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালিতে তো আমরা বেশ ফিকিরবান! কিন্তু কেউ কি এই সমস্যার সমাধানের নিয়তে একদিনও রোযা রেখেছি? কেউ কি কোন সদকা করেছি? কোন কোরবানী করেছি? আল্লাহর সামনে কখনো অশ্রুপাত করেছি? এর মানে হল, আমাদের দুশ্চিন্তা হাকিকী (বাস্তবিক) নয়, বরং মাসনুঈ (কৃত্রিম)। এবং আমাদের এই ইখতিলাফপূর্ণ কথাবার্তা বলতে বেশ মজা লাগে। ফুর্তি লাগে, পুলক অনুভব হয়। এটা আমাদের আখলাকের খুবই জঘন্যতম একটি খারাবী।
ইসলাহের (সংশোধনের) নামে শয়তান আমাদের দ্বারা গীবত করাচ্ছে। বদগুমানী (খারাপ ধারণা) করা, ইলযাম (অপবাদ) আরোপ করা, কথা বিকৃত করা ইত্যাদি করাচ্ছে। [আল্লাহ মাফ করেন, বাংলাদেশে এটাই হচ্ছে।] শয়তান আমাদের দ্বারা তো যিনা করাতে পারবে না, বা তাস তথা জুয়া খেলাতে পারবে না, আমাদের শরাব পান করাতে পারবে না। কিন্তু শয়তান দিনরাত আমাদের দ্বারা মুমিনের বেহুরমতি (অমর্যাদা) করাচ্ছে।
যদি আসলেই (মজুদা হালতের বিষয়ে) ফিকির থাকে তাহলে কথা চালাচালি বন্ধ করুন। রোযা রাখুন, সালাতুল হাজত পড়ে আহাজারি করে আল্লাহর কাছে বলুন, হে আল্লাহ! এই কাজ এবং এর মারাকিজসমূহের হেফাজত করুন। এই কাজের সকলের আকাবির ও পুরানোদের হেফাজত করুন। আল্লাহ! একে উম্মতের ঐক্যের মাধ্যম বানিয়ে রাখুন; বিচ্ছিন্নতার মাধ্যম না বানান। আপনিই করবেন। আপনি করার জন্য যে কাজের কথা বলা হয়েছে তা করার তৌফিক দিন।
কে জানে আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা কি? আল্লাহ তায়ালার সকল ফয়সালাই ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে থাকে এবং হেকমতপূর্ণ হয়ে থাকে। আমার বুঝে আসুক বা না আসুক। আল্লাহ তায়ালা বেনিয়াজ (অমুখাপেক্ষী)। আল্লাহ তায়ালার কোন কিছুকেই কোন পরোয়া নেই। আল্লাহ আল্লাহই।
আমাদের জন্য জরুরী হল নিজের ফিকির করা। আমাদের কি হল? আমি কি নাজাত পেয়ে গেছি নাকি এখনো নাজাতের মুহতাজ (মুখাপেক্ষী) আছি? আল্লাহ কি আমাদের এই কথা জিজ্ঞেস করবেন যে তুমি তাবলীগের কাজকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করে ছিলে? নাকি জিজ্ঞাসা করবেন যে, তুমি চোখের দ্বারা লাখো বার যিনা কেন করেছিলে? তুমি কেন মিথ্যা বলেছিলে, তুমি কি গাফলতের সাথে সময় কাটিয়েছিলে?
তাই ভাই এগুলো অন্য কোন বড়দের জিজ্ঞাসা করুন। আমি এসবের জবাব দেয়ার যোগ্য নয়। [সুবহানাল্লহ! মাওলানা সাজ্জাদ নোমানী বলেছেন তিনি এসবের উত্তর দেয়ার যোগ্য নন। আল্লাহ মাফ করেন! আমাদের দেশে মাদ্রাসার সাধারণ ত্বলাবারাও এ বিষয়ে অনেক বড় বড় কথা অনায়াসে বলে ফেলে।] আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভাবে নীরবতা অবলম্বন করছি। লোকজন আমার ব্যাপারে পিছনের পুরানো কিছু বয়ানের খণ্ডিতাংশ (কাটপিস) নিয়ে ক্লিপ বানিয়ে ইউটিউবে প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, তাবলীগের ইখতিলাফ ও মারকাজ নিযামুদ্দিনের ব্যাপারে মাওলানা সাজ্জাদ নোমানীর খেয়াল এই এই…
আমি আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন কথা বলিনি, আর আমি এর যোগ্যও নই। আমার ঐ দিনগুলোর কথা মনে আছে এবং থাকবে যখন আমি ফকীর ও তালেব হয়ে মারকাজ নিযামুদ্দিনে যেতাম। তখন আমার দিলের যে অবস্থা হত, আমি তা বুঝাতে পারব না। আমার মনে হত, আমি যে দিল্লী ষ্টেশনে নামব, আমি চপ্পল বা জুতা পড়ে নামতে পারব না। এটা আমার মাহবুবের শহর। এরপর জন্য নিযামুদ্দিনের যাওয়ার সড়কে উঠতাম, আমার বারবার এমন হত যে, কোন কোন বাহানায় চপ্পল, জুতা ঝোলার মধ্যে রেখে দিতাম। কেননা যে সড়কে মাওলানা ইলিয়াস রহঃ চলেছেন, আমি জুতা পায়ে সেখানে চলতে পারব না। যখন আমি বাংলাওয়ালী মসজিদের সিঁড়িতে উঠতাম বেশির ভাগ সময়েই আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে আসত। আর যখন আমার মাহবুব, শায়খ ও আমীর আজীব গারীব হাস্তি হযরতজী মাওলানা ইনআমূল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহির মনোয়ার চেহারার দিকে তাকাতাম তখন হু হু করে কেঁদে দিতাম। আমার জিন্দেগী এগুলো অনেক স্মরণে আসে। তাই আমি ঐ মারকাজ এবং ঐ মারকাজের সাথে সম্পৃক্ত যে কাউকে আমার জন্য মুহসীন মনে করি। এবং তাঁদের সাথে কোন ফরক (দুরত্ব) তৈরি করতে প্রস্তুত নই।
আপনারা হযরতদের কাছেও এইটাই নিবেদন, দিল বড় করুন। আপনার যদি দাওয়াতের কাজের সাথে সম্পর্ক থাকে তাহলে নিজ নিজ কাজে লেগে থাকুন, দলাদলি করে বিভক্ত হবেন না। অনেক বড় বড় লোক আছেন তাঁরা এই মামলা দেখছেন। আমাদের সেদিকে না দেখলেও চলবে।
লিঙ্কঃ http://bit.ly/2mrFFZz [12]